‘‘গ্রাম্য পন্ডিত” একটি মজার ছোট গল্প//লেখকের জীবন থেকে নেয়া।।

আমরা ছোটবেলা থেকেই নানান গল্পের ছলে পন্ডিত হিসাবে শুধু শেয়াল মশাইকে জেনে আসছি।  আজ তোমাদের নতুন রকমের পণ্ডিত মশাইয়ের কথা বলব। আমরা যদি অনেক আগের কোনো গল্পের বই পড়ি বা কোনো উপন্যাস পড়ি তাহলে আমরা দেখতে পাব যারা শিক্ষক ছিলেন তাদেরকেও পন্ডিতমশাই হিসাবে বলা হয়ে থাকে।  তাহলে এখন বুঝতেই পারছ এই পন্ডিত মশাই মানে শিয়াল নয়। এ হল আমাদের শিক্ষাগুরু বা গৃহশিক্ষক। 



আমরা যদি লক্ষ্য করি শিয়াল পন্ডিত দের মধ্যেও ভালো খারাপ পাবো তেমনি আমাদের শিক্ষাজীবনের যে শিক্ষাগুরু বা পন্ডিতমশাই আছেন তাদের মধ্যেও আমরা ভালো-মন্দ খুঁজে পাবো। এরকম আমার জীবনের একজন পন্ডিত মশাই এর কথা আমি তোমাদেরকে বলতে যাচ্ছি। 


আমার বাবা ছিলেন কৃষক মানুষ  এবং প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করতেন। তাহলে বুঝতেই পারছ আমার শিক্ষা জীবনটাও ঠিক ওখান থেকেই শুরু হয়।  বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতা ভালো না থাকার কারণে আমাদের পাশের গ্রামে বিহারিয়া নামক  গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুলে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেয়। যেখানে আমার কাজ ছিল ব্যাগভর্তি বই কাঁধে করে স্কুলে যাওয়া এবং ঘুরেফিরে বন্ধুদের সাথে  খেলাধুলা করে বাড়ি ফেরা। 


এখন তুমি ভাবছো, স্কুল থেকে খেলাধুলা এবং ঘুরেফিরে বাড়ি ফেরা, তাই  আবার হয় নাকি!  হ্যাঁ সত্যি আমার জীবনে সেটাই হয়েছে কারণ গ্রামের এই স্কুলগুলোতে কে কত বেশি ফাঁকি দিতে পারে তাহার পাল্লা চলত।  শিক্ষকরা আসছে, খাচ্ছে, টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আর ঠিক যাওয়ার সময় হলে বাড়ি চলে যাচ্ছে।  আবার এমন কিছু শিক্ষক দেখেছি হয়তো কোন  উপরমহলের নজরদারির  তাগিদে ক্লাস নিতে এসেছে। কিন্তু  হুট করে ক্লাস নিতে আসলে কি কোনভাবে কোন ছাত্র-ছাত্রীর  সিলেবাসের সব পড়া মুখস্ত করা সম্ভব? সম্ভব না।  এই সুযোগে পড়া মুখস্থ না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তার সমস্ত রাগ ছাত্র-ছাত্রীদের পিঠের উপর দিয়ে চালিয়ে দিত।


আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন আমার বাবা আমাকে পড়ানোর জন্য একজন গৃহ শিক্ষক রাখলেন। গৃহশিক্ষক রাখলেন কারণ আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি অথচ বলতে গেলে ঠিকমতো অক্ষরজ্ঞান  আমার ভেতরে নেই। গৃহ শিক্ষকের মাসিক বেতন ১২০ টাকা। সপ্তাহের শুধু শুক্রবার বাদ দিয়ে প্রতিদিনই আমাকে পড়াবেন।  আবার একই সময়ে যদি শহরের দিক থেকে কোন শিক্ষক আনতে হয় তাহলে তার মাসিক বেতন দিতে হবে  ৬০০ টাকা।  ১৯৯৬ সালের দিকে একজন কৃষক মানুষের কাছে ৬০০ টাকার মূল্য অনেক বেশি ছিল। যা আমার বাবার বহন করার সামর্থ্য ছিল না।

 তাহলে বুঝতেই পারছো ১২০ টাকার গৃহশিক্ষক আমাকে কি পড়াবেন। এখন আমার গৃহ শিক্ষকের কার্যকলাপ সম্পর্কে যদি তোমরা একটু জানো তাহলে তোমাদের বুঝতে আরো সুবিধা হবে। তিনি প্রতিদিন সকালে উঠে মানুষের বাড়িতে পারিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যেত এবং সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গোসল করে তারপর আমাদের বাসায় আসে আমাকে পড়ানোর জন্য।  কারণ  তিনি ওই সময়ে কোনরকমে এসএসসি পাস করেছিলেন।  রেজাল্ট ভালো না হওয়ায়, ভালো কোন জায়গায় ভর্তির সুযোগ পায়নি এবং কোন চাকরি  জোটেনি তার কপালে। 


কোন ভাল জায়গায় ভর্তি বা চাকরি জোটেনি তাতে কি! গ্রামে তার কড়া পণ্ডিত হিসাবে খ্যাতি আছে।  কারন সে আমাকে ছাড়াও আরও কয়েকজনকে পড়াতেন এবং কড়া ভাবে শাসন করে পড়া আদায় করে নিতেন। ঠিক আমার ব্যাপারে ও একই রকম ঘটতে শুরু করলো। তিনি যখন শাসন করতেন, পিঠের ওপর দিয়ে লাঠি চালাতেন এবং বলতেন তোদের এই রকম সময় আমি কত ভালো পড়াশুনা করতাম তোরা জানিস?  তোদের বয়সে আমি এই বই পড়েছি, ঐ বই পড়েছি, এই  ছড়া মুখস্ত করেছি, ঐ গল্প মুখস্ত করেছি, আরো ইত্যাদি ইত্যাদি।


কিন্তু একাডেমিক বইয়ের বাইরে কোন কিছু জানতে চাইলে বা কিছু জিজ্ঞাসা করলে ক্ষেপে যেতেন। তিনি দুই ঘন্টা ধরে পড়াতেন । ওই সময়ে বইয়ের কোনকিছু বহু মুখস্ত করা, লেখা আবার পন্ডিত মশাই কে মুখস্থ পড়া বলার বাইরে অন্য কিছু করতে পারতাম না। ওর কাছেও ঠিক পড়াশুনার মানে এই ছিল- বউয়ের সাথে হুবহু কোনো কিছু মুখস্থ করে দেয়া।  বইয়ের বাইরে যদি একটা অন্য কোন কথা আসে তাহলে পন্ডিতের পাণ্ডিত্য দেখানো শুরু হয়ে যাবে।  পিঠের ওপরে লাঠির সপাং সপাং শব্দ। 


আমার ওই বয়সে আমি বুঝে উঠতে পারিনি পড়াশোনা কতটা মজার হতে পারে। কারণ মুখস্থবিদ্যা আমাকে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল আমার মনে।  তাই ভালো কোন জায়গাতে না আসা পর্যন্ত আমি কোন প্রশ্নের উত্তর আমার নিজ থেকে দিতে পারতাম না।  পরীক্ষায় কোন প্রশ্নের উত্তর যদি একবার কেটে যায় আমি সেই প্রশ্ন সম্পন্ন করতে পারতাম না কারণ ওই মুখস্তবিদ্যা আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াতে সবসময়। 


আমি এভাবে জ্ঞান আহরণ করার  সমস্ত সামর্থ্য গুলো হারিয়ে ফেলেছিলাম । তাহলে বুঝতেই পারছো  গ্রাম্য পণ্ডিত কোন পর্যায়ে একটা মানুষকে নিয়ে যেতে পারে।  তাহলে আমরা এখন তাদেরকে মন্দ পন্ডিতের  দলে  ফেলতেই পারি। 


 চলো এখন দেখি  এই মন্দ পন্ডিত গুলো এরকম করছ কেন? 


পণ্ডিত গুলোর শিক্ষাজীবনে জ্ঞানের আহরণ খুবই সামান্য যা একজন মানুষকে জ্ঞানী করে তোলার জন্য যথেষ্ট নয়। তোমরা হয়তো একটু খেয়াল করবে যখন আমি পন্ডিত মশাই কে অন্য কোন কথা জিজ্ঞেস করতাম সে সরাসরি আমার উপরে ক্ষেপে যেত। কারণ তার জ্ঞানের পরিধি শুধুমাত্র ছোট্ট একটা বইয়ের মধ্যেই সীমিত ছিল। আমি কোন কথা বলতে বলতে যদি এমন কোনো প্রশ্ন করে বসি, যে প্রশ্নের উত্তর  তাহার জানা নাই, সেই ভয়ে অন্য কোন বিষয়ে কথা বলার প্রশ্রয় দিতেন না। তার পরেও অন্য কোন বিষয়ে গেলে  সোজা লাঠির ধমক।

যখন আমি মার খেতাম পন্ডিত সাহেবের হাতে আমি ভাবতাম আমি একদিন শিক্ষক হব এবং এই মারের  প্রতিশোধ তুলবো।  কিন্তু কিভাবে তুলব কখনো ভাবি নাই। তাহলে  এর থেকে কিন্তু বোঝা যায় আমার স্বপ্নটা ঠিক ঐ  গ্রাম্য পণ্ডিত পর্যন্তই ছিল।  একদিন বড় হবো এবং ছাত্রদের পড়াবো। আর না পারলে  আমি যেভাবে মার খেয়েছি তার প্রতিশোধ তুলে নেব।


এটা সত্যি যে  আজ আমিও শিক্ষক হয়েছি কিন্তু প্রতিশোধ পরায়ন শিক্ষক নয়  বা গ্রাম্য পন্ডিতের মত শিক্ষক নয়। যে শিক্ষার মাধ্যমে সবার প্রথমে ভাবের আদান-প্রদান হয়। তারপর ধীরে ধীরে ছাত্রের ভাবমূর্তির ওপর নির্ভর করে পাঠ্যক্রম এর দিকে  ধাবিত হই। 


আমার ছোটবেলার যে শিক্ষায় আতঙ্ক ছিল তোমাদের এখনকার শিক্ষায় তাহার বিন্দুমাত্র লেশ নেই। তোমরা শিক্ষকের সাথে সবকিছু নির্দ্বিধায় শেয়ার করতে পারো। তোমরা যে কোন কিছু জয় করতে কোনদিনও পিছুপা হবে না।


সর্বশেষ মজার কথাটা এখন তোমাদের  বলি,  আমরা যারা ওই গ্রাম্য পণ্ডিত সাহেবের কাছে পড়তাম তাদের কেউ কেউ ব্যবসা করে আবার কেউ চাকরি করে কেউ বা কৃষি কাজ করে। আমি যখন কোন ছুটিতে বাড়ি যাই তখন আমরা সবাই মিলে যুক্তি করে সেই পন্ডিত মশাইকে মজার ছলে শিয়াল পন্ডিত বলে ডাকি। কিন্তু সে আর আগের মত করে রেগে যায় না। এছাড়া সে বলে তোদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও অনেক শিক্ষিত  হয়েছিস, তোদের অনেক নাম আছে, কিন্তু আমার এ কথা ভাবতেই ভালো লাগে যে আমি একদিন তোদেরকে পাঠ দান করেছি আমার এই সামান্য জ্ঞান দিয়ে। 


 এভাবেই গ্রামের ছেলেদের শিক্ষা জীবনের সংগ্রাম করে আসতে হয়।

যে যত বেশি নিজের সাথে সংগ্রাম করবে সে তত বেশি শিখতে পারবে জানতে পারবে পরিবেশকে তথ্য সহজে নখদর্পণ নিতে পারবে।



ধন্যবাদ

লেখক- অজয় সান্ন্যাল 


Comments